শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণের উৎসবের সূচনা

শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণের উৎসবের সূচনা
শান্তিনিকেতনে প্রথম বৃক্ষরোপণ উদযাপিত হয়েছিল কবিগুরুর ৬৮ বছরের জন্মদিনে, ১৯২৫ সালে। সেই বছর কবি তার বাসগৃহের (উত্তরায়ণ) উত্তরের দিকের পথের ধারে “পঞ্চবটী” প্রতিষ্ঠাই ছিল তার জন্মদিন উদযাপনের প্রধান অঙ্গ। তিনি অশ্ব, বট, বেল, অশোক, এবং আমলকী এই পাঁচ টি গাছের চারা রোপণ করেছিলেন।

১৪ জুলাই ১৯২৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের
গৌরপ্রাঙ্গনে একটি বকুল চারা রোপণের মাধ্যমে বৃক্ষরোপণ উৎসব অনুষ্ঠিত করেন। শান্তিনিকেতনে এই উৎসব ১৯৩৬ সালে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক নিয়মিতভাবে প্রবর্তিত হয় এবং তখন থেকে এটি শান্তিনিকেতনের একটি ঐতিহ্য হিসেবে অব্যাহত রয়েছে। এই ঋতু উৎসবটি সঙ্গীত, নৃত্য এবং বৈদিক মন্ত্রের মাধ্যমে প্রকৃতির উর্বরতাকে আহ্বান করে এবং চিরন্তন যৌবনের প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল ধরে গ্রামাঞ্চলের নির্মম বন উজাড়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
কবির নিজস্ব ভাষায়, তিনি উল্লেখ করেছিলেন “স্রষ্টা জীবন প্রদান করেছেন, সর্বত্র এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। লোভের প্রভাবে মানুষ হত্যার উপকরণ সরবরাহ করেছে। স্রষ্টার অভিপ্রায় লঙ্ঘন করে, মানব সমাজে এত অভিশাপ। বন ধ্বংস করে, লোভী মানুষ নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনে। গাছগুলিকে বায়ু পরিষ্কার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের পতিত পাতা মাটিতে উর্বরতা প্রদান করে, এবং সেগুলি উপড়ে ফেলা হচ্ছে। স্রষ্টার উপকারের জন্য যা কিছু উপহার রয়েছে, মানুষ তাদের নিজেদের মঙ্গল ভুলে গিয়ে সেগুলি নষ্ট করে।” তিনি একটি প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যা জনপ্রিয় কল্পনাকে আকর্ষণ করবে এবং মানুষকে তাদের ভালোবাসার জন্য গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করবে। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকীতে বৃক্ষরোপণ উৎসব ২২ শ্রাবণ (৭ বা ৮ আগস্ট) পালিত হয়।
শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণের ঐতিহ্য
২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রয়াত হন। কবি চেয়েছিলেন, তাঁর শ্রাদ্ধ শান্তিনিকেতনে ‘ছাতিম গাছের তলায়, বিনা আড়ম্বরে বিনা জনতায়’ অনুষ্ঠিত হোক। কবির প্রয়াণ দিবসে শোকসভা না করে, বরং নতুন প্রাণের আবাহনের মাধ্যমে তাঁকে অমর করে রেখেছে বিশ্বভারতী। মঙ্গলবার প্রথা অনুসারে ভোরবেলায় গৌরপ্রাঙ্গণে বৈতালিক, বিশেষ উপাসনা, বৃক্ষরোপণ এবং কবিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে বাইশে শ্রাবণ পালিত হয় বিশ্বভারতীতে।
১৩৪৯ বঙ্গাব্দ থেকে বাইশে শ্রাবণ দিনটি শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। কবি জীবদ্দশায় বহুবার এই উৎসব পালন করেছেন। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ, নিজের জন্মদিনে কবি পঞ্চবটী প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে এই বৃক্ষরোপণের দিনটি বাইশে শ্রাবণে নির্ধারিত হয়। এ দিন শান্তিনিকেতন থেকে শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতীকী পিয়াল ও শিশুর চারা আম্রকুঞ্জে রোপণ করা হয়। বৃক্ষরোপণের পরের দিন, শ্রীনিকেতন মেলার মাঠে হলকর্ষণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
বৃক্ষরোপণের বিশেষ গুরুত্ব:
২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রয়াত হন। কবি ইচ্ছা করেছিলেন, তাঁর শ্রাদ্ধ শান্তিনিকেতনে ‘ছাতিম গাছের তলায়, বিনা আড়ম্বরে বিনা জনতায়’ অনুষ্ঠিত হোক। কবির প্রয়াণ দিবসে শোকসভা আয়োজনের পরিবর্তে, বিশ্বভারতী তাঁকে নতুন প্রাণের আবাহনের মাধ্যমে অমর করে রেখেছে।
শান্তিনিকেতনের বৃক্ষরোপণ এর গুরুত্ব অপরিসীম। এটি কে শুধুমাত্র একটি উৎসব হিসাবে ধরলে অনেক কম ধরা হবে, এটি আসলে গুরুদেব এর দ্বারা সৃষ্ট মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটি অমোঘ যোগ স্থাপন।
গুরুদেব এর দ্বারা মানুষের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসার বীজ রোপণ করে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার এত বছর পর ও এই উৎসবের গুরুত্ব এক ফোঁটাও কমে নি।

যিশুর মানবতার বাণী
“পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি”—এই বেদমন্ত্রের ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ খ্রিস্ট উৎসবের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছিলেন। যিশুর মানবিকতার বাণী আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভগবান ও মানবের একাত্মতার গভীরতা। প্রার্থনা এই, আমরা যেন অন্তরে উপলব্ধি করতে পারি সেই মহান চেতনা।
কবি ১৯২৯ সালের ১০ আগস্ট এই বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে একটি গান রচনা করেছিলেন -
তিন দিনব্যাপী পৌষ উৎসবের শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় খ্রিস্ট উৎসব। মন্দিরের মেঝে রঙিন আলপনায় সজ্জিত করা হয়। ঝাড় লণ্ঠন ও মোমের আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে। শান্তিনিকেতনের নিজস্ব ঐতিহ্য বজায় রেখে উচ্চারিত হয় উপনিষদের মন্ত্র, গাওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের গান—“একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে।” বাইবেলের কিছু অংশও পাঠ করা হয়।
খ্রিস্ট উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হল ছাতিমতলায় বৈতালিক দলের গান। মোমবাতি হাতে তারা যখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ধ্যানবেদীতে উপস্থিত হন, তখন গানের সুরে শান্তিনিকেতনের আকাশে ভেসে আসে—“মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে প্রিয়তম হে জাগো জাগো।”

খ্রিস্ট উৎসবের তাৎপর্য
শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসব শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি মানবতার জয়গান। যিশুর জীবন ও তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তিনি বলেছিলেন, বড়দিন শুধুমাত্র আনন্দের দিন নয়, এটি আত্মপরীক্ষা ও নম্রতার দিন। তাঁর এই উপলব্ধি খ্রিস্টীয় ও ভারতীয় দর্শনের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।
শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসব আজও এক বিশেষ বার্তা বহন করে। এটি শুধুমাত্র একটি ঐতিহ্য নয়, বরং বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে এক বিশ্বমানবতার আহ্বান।