শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসব: রবীন্দ্রনাথের অনন্য সৃষ্টি

শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসব: এক ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক যাত্রাপথ

আজ থেকে একশো আট বছর আগে, ১৯১০ সালের পৌষ উৎসবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। প্রথাগত আদি সমাজীয় উপাসনার সীমা ছাড়িয়ে তিনি বিশ্বমানবের বহুমুখী কর্মধারা, আদর্শ ও সাধনাকে একত্রিত করে শান্তিনিকেতনের প্রথম খ্রিস্ট উৎসব আয়োজন করেন। সেই থেকে মানবপুত্র যিশু খ্রিস্টের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাঁর জীবনদর্শন উদ্‌যাপন করে চলছে শান্তিনিকেতনের এই বিশেষ উৎসব।

রবীন্দ্রনাথ ও যিশুর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলা থেকেই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। শৈশবের এই আন্তরিক মেলামেশা এবং পরবর্তী সময়ে যিশুর জীবন ও খ্রিস্টধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ তাঁকে ‘মানবপুত্র’ যিশুকে ন্যায়, সত্য, প্রেম এবং মানবতার প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াকালীন ফাদার ডি. পেনেরান্ডার মতো খ্রিস্টান যাজকদের সংস্পর্শ তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

খ্রিস্টধর্মের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলা থেকেই খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি খ্রিস্টান মিশনারিদের সংস্পর্শে এসে যিশু খ্রিস্টের জীবন ও শিক্ষা সম্পর্কে গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াকালীন ফাদার ডি. পেনেরান্ডার মতো খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের সান্নিধ্যে তিনি প্রভাবিত হন। তাঁর আত্মজীবনী জীবনস্মৃতি-তে তিনি ফাদার পেনেরান্ডার সম্পর্কে লিখেছেন, “তাঁহাকে দেখিলেই মনে হইত, তিনি সর্বদাই আপনার মধ্যে যেন একটি দেবোপাসনা বহন করিতেছেন।”

যিশু খ্রিস্টকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন ‘মানবপুত্র’, ‘মহাত্মা’, এবং ‘কল্যাণের দূত’ হিসেবে। তাঁর জীবনাদর্শের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন সত্য, ন্যায়, অহিংসা ও মানবকল্যাণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন বিশ্বমানব। তাঁর দৃষ্টিতে সকল ধর্মের মূল ছিল এক। তিনি বিভিন্ন ধর্মের মূল্যবোধ ও শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। যিশু খ্রিস্টের জীবন ও শিক্ষা তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি যিশুকে দেখতেন একজন মহৎ মানব হিসেবে, যিনি মানবতার সেবা করেছেন।

শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলার সময় খ্রিস্ট উৎসব পালন করে রবীন্দ্রনাথ মানুষকে শিখিয়েছিলেন ধর্মের মূল মূল্যবোধের প্রতি সম্মান জানাতে। এই উৎসব শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানই ছিল না, বরং এটি ছিল মানবতার এক উৎসব।

শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসবের বিশেষত্ব হল এটি ধর্মীয় সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে গিয়ে মানবতাবাদী মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেয়। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রমাণ করেছিলেন যে, সকল ধর্মের মূল এক। সকলে মিলে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।

খ্রিস্ট উৎসবের প্রবর্তন

রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তা ও দর্শনের আলোকে ১৯১০ সালের পৌষ উৎসবে খ্রিস্ট উৎসবের প্রবর্তন করেন। এই উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল ভারতীয় ঔপনিষদিক দর্শন এবং খ্রিস্টীয় ভাবনার এক সুন্দর সংমিশ্রণ। তাঁর লেখা গান ও উপাসনা পাঠের মাধ্যমে তিনি যিশুর জীবনাদর্শকে নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করেন।
তিনি লিখেছেন, “খ্রিস্টান ধর্মবুদ্ধি প্রতিদিন বলছে— মানুষের মধ্যে ভগবানের সেবা করো।” তাঁর মতে, যিশুর শিক্ষা শুধুমাত্র পূজার্চনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। মানুষের সেবা ও আত্মত্যাগই ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। এই ভাবনাই রবীন্দ্রনাথের খ্রিস্ট উৎসব উদযাপনের প্রেরণা হয়ে ওঠে।

যিশুর মানবতার বাণী

“পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি”—এই বেদমন্ত্রের ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ খ্রিস্ট উৎসবের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছিলেন। যিশুর মানবিকতার বাণী আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভগবান ও মানবের একাত্মতার গভীরতা। প্রার্থনা এই, আমরা যেন অন্তরে উপলব্ধি করতে পারি সেই মহান চেতনা।

শান্তিনিকেতনে খ্রিস্ট উৎসবের আয়োজন

তিন দিনব্যাপী পৌষ উৎসবের শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় খ্রিস্ট উৎসব। মন্দিরের মেঝে রঙিন আলপনায় সজ্জিত করা হয়। ঝাড় লণ্ঠন ও মোমের আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে। শান্তিনিকেতনের নিজস্ব ঐতিহ্য বজায় রেখে উচ্চারিত হয় উপনিষদের মন্ত্র, গাওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের গান—“একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে।” বাইবেলের কিছু অংশও পাঠ করা হয়।

খ্রিস্ট উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হল ছাতিমতলায় বৈতালিক দলের গান। মোমবাতি হাতে তারা যখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ধ্যানবেদীতে উপস্থিত হন, তখন গানের সুরে শান্তিনিকেতনের আকাশে ভেসে আসে—“মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে প্রিয়তম হে জাগো জাগো।”

খ্রিস্ট উৎসবের তাৎপর্য

শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসব শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি মানবতার জয়গান। যিশুর জীবন ও তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তিনি বলেছিলেন, বড়দিন শুধুমাত্র আনন্দের দিন নয়, এটি আত্মপরীক্ষা ও নম্রতার দিন। তাঁর এই উপলব্ধি খ্রিস্টীয় ও ভারতীয় দর্শনের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।
শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসব আজও এক বিশেষ বার্তা বহন করে। এটি শুধুমাত্র একটি ঐতিহ্য নয়, বরং বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে এক বিশ্বমানবতার আহ্বান।

You may also like

Comments are closed.