রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন, যার প্রতিটি কোণে মিশে আছে ইতিহাসের সুগন্ধ, লাল মাটির মমতা। বিশ্বভারতীর ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো আবিরবিহীন বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হলো। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলা হলেও, আবির ছাড়া বসন্ত উৎসবের এই সিদ্ধান্তে কিছুটা মন খারাপ বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীদের। বসন্ত উৎসব তো বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব উৎসব। এবারও দোলের দিনে বসন্ত উৎসব হচ্ছে না। এই উৎসবে বহিরাগতদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে দোলের কয়েক দিন আগেই ছোট আকারে বসন্ত উৎসব পালন করলেন বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী ও কর্মীরা।
এই বছর ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৪ মার্চ পড়েছে দোল পূর্ণিমা। তার আগেই মঙ্গলবার রীতি মেনে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব পালন করল বিশ্বভারতী। সকাল সাতটা থেকেই গৌড়প্রাঙ্গনে শুরু হয় অনুষ্ঠান। ভোরের বৈতালিক, “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল”, রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে শুরু হলো শোভাযাত্রা। দোল পূর্ণিমার আগেই প্রচলিত রীতি মেনে বসন্ত উৎসব পালন করল শান্তিনিকেতন। উৎসবে শামিল হলেন বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী থেকে অধ্যাপক, কর্মী, আশ্রমিক—সবাই। বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বিনয় কুমার সোরেন বলেন, শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের কর্মভূমি, এখন এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। তাই ঐতিহ্য রক্ষায় এবার বসন্ত উৎসব ঘরোয়া আকারে পালন করা হলো। পর্যটকদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সবাই যাতে আবির না খেলেন, সে বিষয়েও কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বসন্ত উৎসবের আক্ষরিক অর্থ হলো ‘বসন্তের উদযাপন’। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ফাল্গুন ও চৈত্র মাস হলো দোল উৎসবের ঋতু। এই ঋতুতে প্রকৃতি নিজেকে পলাশ, শিমুল ও অন্যান্য রঙিন ফুলের মাধ্যমে সাজিয়ে তোলে। বাংলায় বসন্ত উৎসব উদযাপনের ঐতিহ্য শুরু করেছিলেন নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে। প্রকৃতপক্ষে, বসন্ত উৎসব ও হোলির মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি নয়, শুধু উদযাপনের সৌন্দর্য ও শৈলীতে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।

বসন্ত উৎসব অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসাহের সাথে পালিত হয়। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা, অর্থাৎ দোলপূর্ণিমার দিনেই এই উৎসব উদযাপন করা হয়। সকালে সঙ্গীত ও নৃত্যের এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়, এরপর বিভিন্ন ভবনের (বিভাগের) ছাত্রছাত্রীরা রবীন্দ্রসংগীত, কবিতা ও নৃত্য পরিবেশন করে। এদিন ছেলে-মেয়েরা বাসন্তী রঙের (হালকা হলুদ) পোশাক পরিধান করে, বসন্তের আগমনকে সম্মান ও আনন্দের সঙ্গে বরণ করে নেয়।
দিনের শেষে, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা একে অপরকে রঙিন গুলাল (আবীর) দিয়ে রঙ খেলায় মেতে ওঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমগ্র প্রাঙ্গণ সেই রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। দর্শনার্থীদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো হয় এবং তাদের এই আনন্দোৎসবে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানানো হয়। শুধু রঙের নয়, আনন্দ ও আশার আবহে পরিবেশ হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। সন্ধ্যায় বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনের ছাত্রছাত্রীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচিত নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বসন্ত উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির এক গৌরবময় অংশ হয়ে উঠেছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বসন্ত উৎসবের সময় অসংখ্য বিদেশি পর্যটকের আগমন তার প্রমাণ বহন করে।
👉 বসন্ত উৎসব ২০২৫ – শান্তিনিকেতনের সবচেয়ে রঙিন উৎসব, আগামী ১৪ই মার্চ ২০২৫, শুক্রবার (২৯শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ) তারিখে পালিত হবে মেলা প্রাঙ্গণ, পূর্বপল্লীতে। এটি ধর্মীয় নয়, বরং রঙ ও প্রকৃতির উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়। বসন্ত নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে আসে, শীতের কঠোরতা শেষে প্রকৃতিতে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয়। শান্তিনিকেতন ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয়ে ওঠে এই রঙিন উৎসবের জন্য। ২০২৫ সালেও এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব তার রঙ, প্রকৃতি ও মানবিক আবেগের অপূর্ব সংমিশ্রণে এক নতুন প্রাণ পাবে।
বিশ্বভারতীতে আজই বসন্ত উৎসব পালন, জেনে নিন অনুষ্ঠানসূচি :
১৪ মার্চ সারা দেশে পালিত হবে দোল উৎসব। তবে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে মঙ্গলবার, যা মূল দোলের কয়েকদিন আগেই পালিত হয়। বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী ও কর্মীরা একটি ঘরোয়া আয়োজনে বসন্ত উৎসব পালন করবেন।
চলতি বছরও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ মূল দোলের দিন বসন্ত উৎসব আয়োজন করছেন না। পরিবর্তে মঙ্গলবার গৌর প্রাঙ্গণে হবে ঘরোয়া উদযাপন। সোমবার থেকেই সঙ্গীত ভবন ও শ্রীনিকেতনের ফ্রেস্কো মঞ্চে প্রস্তুতি পর্ব চলছে।
অনুষ্ঠানসূচি (বিশ্বভারতী বসন্ত উৎসব ২০২৫):
- সোমবার সন্ধ্যা ৭টা – বসন্ত বন্দনা (গৌর প্রাঙ্গণ)
- রাত ৯টা – বৈতালিক
- মঙ্গলবার ভোর ৫টা – বৈতালিক
- সকাল ৭টা – শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
- সন্ধ্যা ৭টা – গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’
অন্যদিকে, শান্তিনিকেতনের রতনপল্লী, জামবুনি, শ্রীনিকেতন, কঙ্কালীতলা সতীপীঠ সহ অন্যান্য এলাকাগুলিতে স্থানীয় উদ্যোগে বসন্ত উৎসবের আয়োজন চলছে। সোমবার শান্তিনিকেতন থানায় উৎসব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বন দপ্তর থেকে কিছু নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে – যেমন জঙ্গল এলাকায় আবীর খেলা, ছবি তোলা, গাড়ি পার্কিং ও ড্রোন ওড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সোনাঝুরি হাট এলাকায় সম্পূর্ণভাবে আবীর খেলা নিষিদ্ধ।

Comments are closed.