শান্তিনিকেতন

সত‍্যের সুষমা : শান্তিনিকেতনে জীবনের ছবি

দৈনন্দিন যাত্রা

আমাদের শিশিক্ষু মনে সরলতার প্রজাপতি ঘুরে বেড়ায় সঙ্গোপনে। পথ যখন হাসিখুশির ফুল ফোটায় তখন সেই প্রজাপতিই রেণুকে করে ফেলে একাকার। মগডালে বাসা বাঁধে যে-পাখি সেও চুপিচুপি আশ্রমের স্বপ্ন দ‍্যাখে। ডানায় জড়িয়ে নেয় বোঝাপড়ার সহজ লীলা। সকাল থেকে দোদুল-দুল কৃষ্ণচূড়ায় লাল টকটকে আভাস সিঁদুরে মেঘকেও হার মানায়। ঘর-পোড়া গোরু শান্তিনিকেতনে এসে ভয়ডর ভুলে ফের ভালোবাসতে শেখে। সে ভালোবাসা একার নয়; অসংখ‍্যের মধ‍্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রেরণায় তার সহাবস্থান। আন্তরিকতার নৈঃশব্দ্য তিলে তিলে সঞ্চয় করে একদিন রবীন্দ্রনাথ যেমন উজাড় করে দিয়েছিলেন ভালোবাসার পাত্রখানি তাতে তাঁর পিতৃদেবের শিক্ষা, পারিবারিক সংস্কৃতি ও রুচির লালিত‍্য ছিল প্রধান উপকরণ। ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’-এ তিনি বালকবয়সের শান্তিনিকেতন-ভ্রমণ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন “আমি যে বারে তাঁর সঙ্গে এলুম সে বারেও ড‍্যালহৌসি পাহাড়ে যাবার পথে তিনি বোলপুরে অবতরণ করেন। আমার মনে পড়ে সকালবেলায় সূর্য ওঠবার পূর্বে তিনি ধ‍্যানে বসতেন অসমাপ্ত জলশূন‍্য পুষ্করিণীর দক্ষিণ পাড়ির উপরে। সূর্যাস্তকালে তাঁর ধ‍্যানের আসন ছিল ছাতিমতলায়। এখন ছাতিম গাছ বেষ্টন করে অনেক গাছপালা হয়েছে, তখন তার কিছুই ছিল না, সামনে অবারিত মাঠ পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত ছিল একটানা। আমার ‘পরে কটি বিশেষ কাজের ভার ছিল। ভগবদগীতা-গ্ৰন্থে কতকগুলি শ্লোক তিনি চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন, আমি প্রতিদিন কিছু কিছু তাই কপি করে দিতুম তাঁকে। তার পরে সন্ধ‍্যাবেলা খোলা আকাশের নীচে বসে সৌরজগতের গ্ৰহমণ্ডলের বিবরণ বলতেন আমাকে, আমি শুনতুম একান্ত ঔৎসুক‍্যের সঙ্গে। মনে পড়ে আমি তাঁর মুখের সেই জ‍্যোতিষের ব‍্যাখ‍্যা লিখে তাঁকে শুনিয়েছিলুম। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যাবে শান্তিনিকেতনের কোন্ ছবি আমার মনের মধ‍্যে কোন্ রসে ছাপা হয়ে গেছে। প্রথমত সেই বালকবয়সে এখানকার প্রকৃতির কাছ থেকে যে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেম―এখানকার অনবরুদ্ধ আকাশ ও মাঠ, দূর হতে প্রতিভাত নীলাভ শাল ও তাল শ্রেণীর সমুচ্চ শাখাপুঞ্জে শ‍্যামলা শান্তি, স্মৃতির সম্পদরূপে চিরকাল আমার স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। তার পরে এই আকাশে এই আলোকে দেখেছি সকালে বিকালে পিতৃদেবের পূজার নিঃশব্দ নিবেদন, তার গভীর গাম্ভীর্য। তখন এখানে আর কিছুই ছিল না, না ছিল এত গাছপালা, না ছিল মানুষের এবং কাজের এত ভিড়, কেবল দূরব‍্যাপী নিস্তব্ধতার মধ‍্যে ছিল একটি নির্মল মহিমা।” গভীর গাম্ভীর্যের সঙ্গে কতখানি সংযমের সাধনা লীন হয়ে আছে তাঁদের নিষ্ঠায়, কাজের ব‍্যাপ্তিতে তা সহজেই অনুমান করা যায়। শিল্পিত স্বভাবে আবেগের গলা টিপে ধরলে ভাবটাই ফ‍্যাকাসে হয়ে পড়ে। জীবনযাপনে যেমন সংযমের মাত্রা থাকা দরকার তেমনই আবেগের মূল‍্য। শান্তিনিকেতন নিয়ে আবেগবশত কিছু ভাবলাম আর সেটাই হয়ে গেল একটি তাৎক্ষণিক প্রকল্প! তা যে দৈনন্দিন যাত্রাপথে অগোচরেই থেকে যাবে, মিলাবে-মিলিবে না।

ঘরের প্রলাপ

মাটির বাড়ি, খড়ের চাল―তার মধ‍্যে বর্ষাকাল। কবিদের শুনতে হয় গঞ্জনা। স্ত্রীর কাছে রোজগেরে না হলে চলে কীভাবে! ভারতচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ―এ বিষয়ে আলোকপাত না করে কেউই থাকতে পারেননি। ঘরের মায়া পথের চেয়ে দামি। গৌরের মতো পথের ধুলোয় গড়াগড়ি দিতে হলেও ঘরের বাঁধন শিথিল করতে হয়। ‘বাজে কথা’র মূল‍্য যেমন বেশি, বাইরের সিরিয়াস কথাবার্তা এবং কাজের চেয়ে ঘরের―অন্দরমহলের নিকষ-উজ্জ্বল টুকরোকথার ব‍্যঞ্জনাও মহত্ত্বে সমাকীর্ণ। অথচ এখন ব‍্যাপারটা যে-জায়গায় দাঁড়িয়েছে, তা হল
কে রাখে কার খোঁজ
নিজের ভালো নিজে বোঝ।
ঘর-বাহির হয়েছে সমান। যাদের আমরা গুণহীন স্বজন বলে জানি তাদের ছেড়ে গুণবান পরের কাছে হাত পাততে ভালোবাসি। ইচ্ছেটা এরকম যে আপদ বিদেয় হলেই ভালো। কিন্তু ধান থেকে চাল-খই দুটিই হয়, শেষযাত্রায়, বিদায়ের দিনে খইছড়ানোর রীতি যেমন আছে, তেমনি আছে শ্রাদ্ধকাজে পেটপুরে ভাত খাওয়ানোর প্রথা। একে-অপরকে ছেড়ে চলে কী করে?

ফাঁকি-দেওয়া জীবন

নিজেকে ফাঁকি দেওয়া সহজ কাজ। ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে দিন কাটালেই হল। ছাতিফাটা গ্ৰীষ্মের বিকেল থেকে সন্ধ‍্যা-রাত অব্দি মেলার মাঠে আলস‍্য করে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে কাটিয়ে দিলেই হল! কিন্তু একদিন সেই ফাঁকিটাই, সেই পেখমমেলা ঘুমটাই একঘেয়ে হয়ে পড়ে। তখন আর ভালো লাগে না। মানুষ মানুষের সান্নিধ্য চায়, শিক্ষার আলো জ্বেলে রাখতে চায় বুকের মাঝে। সকল কাজে তার একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় আছে, তাকে ভুলে হেলায় আমোদ করা তার সাজে না। পাঠভবন-শিক্ষাসত্রের আনন্দে রয়েছে একটি লীলায়িত ছন্দ―যার মধ‍্যে দল, মাত্রা, পাপড়ি, বৃন্ত, কুসুমের সামঞ্জস‍্য পরম রমণীয় হয়ে উঠেছে। ফাঁকির মধ‍্যেও জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা রয়েছে। জীবন একলার নয়, অসংখ‍্যে পরিব‍্যাপ্ত ভালোবাসা সেই ফাঁকির অবলম্বন। সাধ‍্য কম থাকলেই বা, সাধটাকে বুকের ভিতর দুমড়ে-মুচড়ে নষ্ট করে লাভ কী! সেটাকে আকাশতলে এলিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।