
জানেন তো, প্রথম পৌষমেলায় কত খরচ হয়েছিল ?
জানেন তো, প্রথম পৌষমেলায় খরচ হয়েছিল ১৭৩২ টাকা ১০ আনা। পৌষ উৎসব-মেলাকে গুরুদেব তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষাদর্শের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। শান্তিদেব ঘোষ একবার বলেছিলেন, “সাতই পৌষের উৎসব শান্তিনিকেতনের দুর্গোৎসবের মতো। ভোরবেলায় বৈতালিকে ‘তোমার নাম দিয়ে দাও ধুয়ে’ গানটি গেয়ে দিনুদার পাশে পাশে আশ্রম পরিক্রমা করতাম।”
কল্পনা করুন একবার—পৌষ উৎসবে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ; সঙ্গে ক্ষিতিমোহন সেন, সাগরময় ঘোষ। প্রমথনাথ বিশী স্মরণ করেন, “সন্ধ্যার আগে খাওয়া-দাওয়া ছিল বেশ রাজকীয়। খাবারের পরে আবার মন্দিরে যাওয়া, মন্দিরের সেই অসাধারণ আলোকসজ্জা!”
কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম দিকের অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে পৌষমেলা সম্প্রচার দর্শকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল। গত বছর ১২০ বছর পূর্ণ করেছে এ মেলা। প্রথম পৌষমেলায় খরচ হয়েছিল ১৭৩২ টাকা ১০ আনা। মেলার রূপে কত পরিবর্তন এসেছে! গত চল্লিশ বছরে ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়েছে এই পরিবর্তনের নানা দিক। মেলার গ্রামীণ চরিত্রে শহুরে প্রভাব এসে পড়েছে। এখন মেলায় গাড়ি, টিভি, স্কুটার, কম্পিউটারের স্টল দেখা যায়, তবে সেই সাবেকি মেলার মাটির পুতুল, কাঠের খেলনা, সাঁওতালদের বাঁশি, তিরধনুক, রূপদস্তার গয়না—এসব এখনো হারিয়ে যায়নি।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পৌষমেলার আয়োজন করেছিলেন কলকাতার কাছে গোরিটির বাগানে। পঞ্চাশ বছর পর, ১৮৯৪ সালে, মহর্ষির ট্রাস্ট ডিড অনুসারে শান্তিনিকেতনে আনুষ্ঠানিকভাবে পৌষমেলার সূচনা হয়। তবে পৌষ উৎসব শুরু হয়েছিল ১২৯৮ সালের ৭ পৌষে, ইংরেজি ১৮৯১ সালে। মহর্ষি কখনো শান্তিনিকেতনের মন্দির বা মেলা দেখেননি।
বর্তমানের মেলা এক বিপুল জনসমাবেশে পরিণত হয়েছে, বিশেষত ২৫ ডিসেম্বরের ভিড় যেন উপচে পড়ে। তবু মন্দিরে আয়োজিত খ্রিস্টোৎসবের সৌন্দর্য আজও অমলিন। আশ্রমিক সংঘের বার্ষিক অধিবেশন, প্রাক্তন আশ্রমিকদের স্মরণসভা, সাঁওতালদের খেলাধুলা, আর রাতের বাজি পোড়ানো মেলার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। মেলার শেষের বাজি, যেখানে রবীন্দ্রনাথের মুখ ভেসে ওঠে, সত্যিই মুগ্ধ করে।
রবীন্দ্রনাথ প্রতি ৭ পৌষে মন্দিরে যে ভাষণ দিতেন, তা ছিল আশ্রমবাসীদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। “…তিনি আজ এই পুণ্যদিনের প্রথম ভোরের আলোতে উৎসব দেবতার উজ্জ্বল বেশ পরে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন— জাগো, আজ আশ্রমবাসী সকলে জাগো।”
১৯৯১ সালে দূরদর্শনে পৌষ উৎসবের শতবর্ষ এবং ১৯৯৪-এ মেলার শতবর্ষের লাইভ সম্প্রচার হয়েছিল। সেই সময় ছাতিমতলায় উপাসনায় উপাচার্য সুরজিৎ সিংহ, গানে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, পাঠে সুপ্রিয় ঠাকুর, এবং মন্ত্রোচ্চারণে মোহনলাল বাজপেয়ীর মতো ব্যক্তিত্বদের দেখা যেত। মেলায় পুরনো আশ্রমিকদের ভিড়, শঙ্খ ঘোষ, শম্ভু মিত্র, অমর্ত্য সেনের উপস্থিতি ছিল বিশেষ স্মরণীয়।
বাউলদের আখড়ায় রাত জেগে সনাতন দাস বাউলের গান শোনা, কিংবা মেলায় ‘চাঁদের হাট’-এর মতো সৃষ্টিশীল উদ্যোগ আজও শান্তিনিকেতনের অতীতকে বর্তমানের সঙ্গে জুড়ে রাখে। সব মিলিয়ে, পরিবর্তনের মধ্যেও মেলার ঐতিহ্য আজও অনেক কিছু ধরে রেখেছে।
Comments are closed.