শীত, সন্ধ‍্যা ও শান্তিনিকেতন

শীত, সন্ধ‍্যা ও শান্তিনিকেতন

শীত ও সন্ধ‍্যার রূপকল্পে শান্তিনিকেতনের গদ‍্যপদ‍্যময় আশ্রয়টি কেমন হতে পারে, তা অনুমান করতে হলে গোয়ালপাড়া থেকে বোলপুরের সীমানা ছাড়িয়ে রায়পুরের খেজুর-রসের রসিক বিক্রেতাদের মিঠে হাসির দিকে তাকাতেই হবে। নলেন গুড়ের মধ‍্যে ডুবে থাকার আনন্দই রসিকচিত্তের হৈমন্তিক প্রাপ্তি। সত‍্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

রূপশালি ধান বুঝি
এইদেশে সৃষ্টি,
ধূপছায়া যার শাড়ী
তার হাসি মিষ্টি।

শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের মুখের হাসি অমল ধবল পালে মন্দ মধুর হাওয়া লাগার মতোই। স্কুলপড়ুয়াদের এক ঝলক দেখলেও প্রাণে কৈশোরক চপলতার তরঙ্গ খেলে যায়। পদাবলির কবি বহু আগে বাংলার পথে পথে সেই উচ্ছ্বসিত অনুরাগের আরক্তিম মণিকণা ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ‍্যোতি।
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি।।
রাধার চলনের বিভায় যদি স্থলপদ্ম প্রস্ফুটিত হয় তাহলে আলোর আমোদে কাজ কী! কিন্তু শান্তিনিকেতনে আলো-ছায়ার কারবার নিত‍্যদিনের। ছায়ার সাংকেতিক আবদার আলোর চেয়ে একটু বেশিই। তাকে প্রগলভ ভুঁইফোড় মনে করার কোনও কারণ নেই। উপাসনার আসরে লাভ-লোকসানের চিন্তামুক্ত নির্মল ব‍্যক্তিত্বের উপস্থিতির একান্ত অভাব। দিনে দিনে সোশ‍্যাল মিডিয়ায় শ্বেতশুভ্র পোশাকের কোজাগরী অসহ‍্য হয়ে উঠছে। অনাড়ম্বর জীবন চোখে পড়ে না বিশেষ। যাকে চিনতে চাই সে সামনে থাকলেও আমরা মুখ ফিরিয়ে চোখ এড়িয়ে চলে যাই বাঁকা-পথে। ‘কী চাই?’-এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
প্রতিদিন প্রাতে যখন অন্ধকারের দ্বার উদ্ঘাটিত হয়ে যায়, তখন যেন দেখতে পাই, বন্ধু, দাঁড়িয়ে আছ; সুখের দিন হোক, দুঃখের দিন হোক, তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল, আজ আমার আর ভাবনা নেই, আমার আজ সমস্তই সহ‍্য হবে। যখন প্রেম না থাকে, হে সখা, তখনই শান্তির জন‍্যে দরবার করি। তখন অল্প পুঁজিতে যে কোনো আঘাত সইতে পারি নে। কিন্তু যখন প্রেমের অভ‍্যুদয় হয় তখন যে-দুঃখে যে-অশান্তিতে সেই প্রেমের পরীক্ষা হবে সেই দুঃখ সেই অশান্তিকেও মাথায় তুলে নিতে পারি। হে বন্ধু, উপাসনার সময় আমি আর শান্তি চাইব না―আমি কেবল প্রেম চাইব। প্রেম শান্তিরূপেও আসবে, সুখ হয়েও আসবে দুঃখ হয়েও আসবে―সে যে-কোনো বেশেই আসুক তার মুখের দিকে চেয়ে যেন বলতে পারি : তোমাকে চিনেছি, বন্ধু, তোমাকে চিনেছি।
বন্ধুর প্রতি আশা-আকাঙ্ক্ষা অন্তহীন। স্রোতস্বিনী নদীর ধারাবাহিত জলনীলিকায় মন্থর শব্দকূজন শোনা যায় বৈকী! কিন্তু আনন্দ? যে-আনন্দ দেয়, তার নিকষিত অন্তরের খোঁজ কি রাখি আমরা? অজিত দত্ত লিখেছিলেন ‘সে-খোঁজে কী কাজ, বন্ধু?’ কাজ থাকুক বা না-থাকুক মুকুলিত অন্তরের সন্ধান চলতে থাকুক।

প্রার্থনায় যা পাই না, বিপ্লবে যা হাসিল করতে পারি না, ভালোবাসায় তার সবটুকু মিটিয়ে নিতে চাই। এই চাওয়ার ভিতরেই কত গুঞ্জন, কত প্রলাপ―কত আবোল-তাবোল, জলছড়ার নকশা-কোলাজ! অথচ যা চাইতে পারি না, মানভঞ্জনের কুশল-সংলাপ আয়ত্ত করতে না পেরে চেয়ে থাকি চূর্ণ পাথ‍রের বুকে ফুটে-ওঠা কচি ফুলের দিকে, তাদেরই আহ্বানে মিলন-দিগন্ত হয়ে ওঠে নহবত-রোশানাইয়ের হিরণ্ময় অবসর। শান্তিনিকেতনের প্রেম সুখ-দুঃখময় আনন্দের সমাহারে আয়োজনহীন গীতিকবিতার কথা বলে। আটপৌরে সাদামাটা জীবন রসিকতার ভাসা-ভাসা মেঘে আর নিষ্পাপ মুগ্ধবোধে জলমগ্ন হয়ে থাকতে চায়।

 

You may also like

Comments are closed.